শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৭ পূর্বাহ্ন
‘উত্তরাধিকার আইন, নিজে জানো ও অপরকে শেখাও, সকল জ্ঞানের অর্ধেক হলো এই জ্ঞান’—বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ সা. ১৪শ’ বছর আগেই বলে গিয়েছেন এ কথা। মুসলিম আইনে কোরআন, সুন্নাহ ও ইজমার ওপর ভিত্তি করে মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়ে থাকে। এভাবে বণ্টন করাকে ফারায়েজ বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুর পর সম্পদের অধিকার বা মালিকানা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বৈধ ওয়ারিশদের কাছে চলে যায়। বেঁচে থাকতেই শুধু কাউকে বঞ্চিত করার সুযোগ থাকে। এই সুযোগটাই মানুষের জন্য এক বড় ফেতনা। অর্থাৎ, মহাপরীক্ষা।
ইসলামী আইনে কোনো মুসলমান মারা গেলে তার সম্পত্তি বণ্টনের আগে কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। ১. মৃত ব্যক্তির পর্যাপ্ত সম্পত্তি থাকলে সেখান থেকে তার দাফন-কাফনের যাবতীয় খরচ মেটাতে হবে।
২. জীবিত থাকা অবস্থায় কোনো ধারদেনা করে থাকলে তাও রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে পরিশোধ করে দিতে হবে।
৩. তার স্ত্রী বা স্ত্রীদের দেনমোহর পরিশোধিত না হয়ে থাকলে বা আংশিক অপরিশোধিত থাকলে তা পরিশোধ করে দিতে হবে। মোট কথা স্ত্রীর সম্পূর্ণ দেনমোহর স্বামী মৃত অথবা জীবিত যাই থাকুন না কেন তা স্বামীর সম্পত্তি থেকে আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে হবে।
৪. মৃত ব্যক্তি কোনো উইল বা অসিয়ত করে গেলে তা পালন করতে হবে। কোনো ব্যক্তি তার সমগ্র সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত অসিয়ত করতে পারে। অসিয়তের এই নিয়ম প্রবর্তনের কারণ হচ্ছে, মীরাসী আইনের মাধ্যমে যেসব আত্মীয়স্বজন পরিত্যক্ত সম্পত্তির কোনো অংশ পায় না, এখান থেকে তাদের যাকে যে পরিমাণ সাহায্য দেওয়ার প্রয়োজন উপলব্ধি করা হয়, তা নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেমন—কোনো এতিম নাতি বা নাতনি রয়েছে। মৃত পুত্রের কোনো বিধবা স্ত্রী কষ্টে জীবনযাপন করছে। অথবা কোনো আত্মীয় সাহায্য-সহায়তা লাভের মুখাপেক্ষী। এ ক্ষেত্রে অসিয়তের মাধ্যমে তাদের অন্য হকদারদের জন্য বা কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে সম্পত্তির অংশ অসিয়ত করতে পারেন।
সম্পত্তি অল্প হোক কিংবা বেশি : পবিত্র কোরানের সুরা নিসার ৭নং আয়াতে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে; অল্প হোক কিংবা বেশি।
উত্তরাধিকার থেকে কে বঞ্চিত হবে কে হবে না : কেউ কাউকে হত্যা করলে হত্যাকারী তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না। ধর্ম ত্যাগকারী স্বাভাবিক নিয়মে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু স্বধর্ম ত্যাগ না করে ভিন্ন ধর্মের কাউকে বিয়ে করলে উত্তরাধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা যাবে না। একইভাবে সৎ বাবা বা সৎ মা, সৎ ছেলে-মেয়ের সম্পত্তি পায় না। মুসলিম সন্তানও তার বিধর্মী পিতা-মাতার উত্তরাধিকার পাবে না।
ইসলামী শরিয়তে উত্তরাধিকার উন্মুক্ত হওয়ার পূর্বে মৃত লোকের কোনো ছেলে কিংবা মেয়ের মৃত্যু ঘটলে ওইরূপ ছেলে কিংবা মেয়ের সন্তানাদি উত্তরাধিকার পায় না। ইসলামী শরিয়তে আগে এই নিয়ম ছিল এবং এখনও আছে।
সামাজিক হীনম্মন্যতার যুগে দাদা যদি নাতির ভবিষ্যতের জন্য দান বা অসিয়ত না করে যেতে পারেন, নিগৃহীত হতে পারে অসহায় নাতি। এর সমাধান করতে গিয়ে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১-এ ধারা-৪ সন্নিবেশিত হয়। এখন নাতি-নাতনিরা মৃত বাবার সম্পত্তি পেলেও এটা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করছে। ৪ ধারার কারণে অনেক ক্ষেত্রে স্পষ্টত শরিয়তের লঙ্ঘন এবং অনিয়ম হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এই ধারার কারণে সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকারীরা বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে। এতিমরা যাতে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হয় সেই সম্পর্কে ইসলামে নির্দেশ দেওয়া আছে, ‘সম্পত্তি বণ্টনের সময় যখন আত্মীয়স্বজন, এতিম ও মিসকিন উপস্থিত হয়, তখন তা থেকে তাদের কিছু দিয়ে দাও এবং তাদের সাথে কিছু সদালাপ কর।’ (সুরা নিসা, আয়াত ৮ )
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে কেউ কারও সম্পত্তি পাবে না। জারজ সন্তান পিতার উত্তরাধিকারী হয় না, কিন্তু তার মা ও মায়ের আত্মীয়দের থেকে সম্পত্তি সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী পাবে (মুসলিম হানাফী আইন অনুসারে)। শরিয়া আইনে শারীরিক কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে কাউকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার কোনো সুযোগ নেই। তবে মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যেহেতু তার সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো করার সক্ষমতা রাখে না, তাই তার সম্পত্তি তার কল্যাণে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে একজন অভিভাবক নিযুক্ত করতে হবে। সালিশ কিংবা আদালতের মধ্য দিয়ে এই অভিভাবক নিযুক্ত করা যায়।
ইসলামী আইনে দত্তক সন্তান উত্তরাধিকার পাবে না। সম্পদের উত্তরাধিকার প্রয়োজন হয় মূলত ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য। যে কেউ তার অধীনে থাকা পোষ্য বা পালিত সন্তানের নিরাপত্তায় জীবিতাবস্থায় সম্পদ দান করতে পারেন; এমনকি সব সম্পদও। ধর্ম বা আইন এতে বাধা দেয় না। মৃত্যুর পর কার্যকর করতে এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত অসিয়ত করে যেতে পারে। চাইলে ওয়াক্্ফ বা ট্রাস্ট করে যেতে পারেন। বাংলাদেশের আইনে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিযুক্ত করতে পারেন, এমনকি নাবালক পোষ্যকেও। সম্পদ কেনার সময়েই পোষ্যর নামে কিনতে পারেন। প্রত্যেকের সম্পদ, সামর্থ্য এক নয়, তাই যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী পোষ্যোর ভবিষ্যতের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে যাওয়া কোনো কঠিন কাজ নয়।
মুসলিম আইনে সন্তানের উত্তরাধিকার জন্মসূত্রেই সুস্পষ্ট, যা কোনোভাবেই খর্ব করা যায় না। ত্যাজ্যপুত্র একটি ভ্রান্ত ধারণা, যা বাংলাদেশের কোনো আইনে বিধিত নেই। প্রকৃত মুসলিম আইন না জানার কারণে এমন অমূলক একটি বিষয় সমাজে প্রচলিত এবং তা নানা রকম সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করছে। ত্যাজ্যপুত্র ধারণাটি বাংলাদেশে মুসলমানদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় পিতার মৃত্যুর পর অন্য উত্তরাধিকারিরা সম্পত্তি বণ্টনের সময় অংশ দেয় না বা দিতে অনিচ্ছুক হয়। অপরদিকে প্রকৃত আইনের অজ্ঞতার কারণে সালিশকারীদের পক্ষপাতমূলক বা ভুল সিদ্ধান্ত দিতে দেখা যায়। এতে মুসলিম আইনের লঙ্ঘন ঘটে। আর তাই ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আইনের আশ্রয় নিতে পারেন তার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এক্ষেত্রে ১৮৯৩ সালের বাটোয়ারা আইনে কোট ফি দিয়ে দেওয়ানি আদালতে বাটোয়ারা মামলা করা যায়। এছাড়াও মৃত ব্যক্তির কোনো উত্তরাধিকার না থাকলে এবং তা তিনি জীবিতকালে কাউকে না দেওয়ার ব্যবস্থা করে গেলে সরকার তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে।
বাপের বাড়ির হক : খুবই পরিচিত একটা অধিকার বাপের বাড়ির হক। এখন একটি কঠিন বাস্তবতা। অনেক ক্ষেত্রে ধনী বোন উত্তরাধিকার দাবি করে না অথবা ভাইরা যা দেয় তাও নিতে চায় না। কেউ কেউ সম্পত্তি নিলেও পাওনার হিসাব দেখেন না। এতে বাপের বাড়িতে অন্যদের তুলনায় কদর অনেক বেশি হয়। কিন্তু সবার আর্থিক অবস্থা হয়ত ওই বোনটার মতো নাও হতে পারে। অন্য বোনদের তাই ওয়ারিশের অধিকার দাবি করতেই হয়। এক বোনের ভালোমানুষী কর্মকা- উত্তরাধিকার দাবি করা অন্য বোনদের লোভী বানিয়ে দেয়, অন্তত বাপের বাড়ির লোকজনের চোখে। স্বামীর আর্থিক সামর্থ্যরে কারণে অথবা বাপের বাড়িতে আদর পাওয়ার উদ্দেশ্যে যে বোন উত্তরাধিকার নেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে না, সে দুটো কারণই অনিশ্চিত ভবিষ্যতে নাও থাকতে পারে। সম্পত্তির প্রয়োজন কাল হতে পারে। তখন হয়ত আপনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন।
প্রায়ই দেখা যায়, পরিবারের সদস্যকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করে অন্য সদস্যরা। আমাদের একটি কমন মানসিকতা—আমরা শোষিত। চারপাশে অথবা নিজের পরিবারের দিকে নজর দিলে দেখা যায় অনেক শোষিত মুখ। যে বোন ভাইয়ের বঞ্চনা, প্রতারণার কারণে নিজেকে শোষিতের কাতারে মানছেন, তিনিও কারও হয়তো মা। তিনি কি সঠিক অর্থে ন্যায়বিচার করছেন, নিজের মেয়েটার প্রতি। তিনি কি ছেলেমেয়ের অধিকার অন্তত সম্পত্তির ক্ষেত্রে দিচ্ছেন। বাপের সম্পদ হতে বঞ্চিত হওয়ার পরও যা মিলছে তাও কি সুষম বণ্টন হচ্ছে। কম পেলেন বলে যদি আপনি বঞ্চিত, আপনার মেয়ের তো কমের ভাগ ‘মহাকম’টুকু পেল না। তাদের কী বলা হবে? আমরা নিজেরাই যখন অন্যায় করি, অধিকার আদায়ে বেশি চাপ দিতে পারি না। বাপের বাড়ির লোকজন প্রথমেই যে কয়টা যুক্তি দাঁড় করায় তার একটা এই ‘চেইন-অবিচার’। তুমি তোমার মেয়েকে কী দিয়েছ বা কী দেবে। এই প্রশ্নের সত্যিকার উত্তরটি ন্যায়বিচারে মানানসই নয়।
সূত্র : অনলাইন